(১)
কুষ্টিয়া হতে ফরিদপুর বেশি দুরে নয়। এই পদ্মার পারে এসে আমার তাই রবীন্দ্রনাথের সোনারতরীর কথাই মনে পড়ছিলো। এসেছি বাপাউবো-এর সিএনবি ঘাট আর গদাধরডাঙ্গী (লুকাল নেম গোদাডাঙ্গী) নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের সাইটে। শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ১৮-১৫ কিলো। কন্ট্রাক্টর আর সাব-কন্ট্রাক্টরদের-এর ভীড়ে (ম্যাক্ক্সিমামই লুকাল টাফ লুক) আর চাকুরীর শেষ প্রান্তে চলে আসা বৃদ্ধ-গোটা দুয়েক সেকশন অফিসারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত আমি। তারপরে শুনি ওইপারে রাজবাড়ী জেলার সর্বহারারা নাকি নৌকা নিয়ে জলপথে হামলা করে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ব্যাপক টেনশনে পড়লাম। এইখানে সাতদিন থাকবো কিভাবে। সাব-কন্ট্রাক্টর দুলাল বললো ভয় নাই ছার আমি দুই হাতে স্টেনগান চালাইতে পারি-লেবাররা অনেক আছে দুইশর উপরে। আমি মনে মনে বললাম, শালা তর সাইটে কি স্টেনগান আছে???!!!! সেইরকম হইলে তোরে লাগবে না আমি চালাইতে পারবো।
আপস্ট্রীমে সিএনবি ঘাটে একটি ব্রোথেল আছে। লোকালয় বলতে এই। আর আছে নদী ভাঙা মানুষের অস্থায়ী নড়বড়ে পাটখড়ির ঘর। চা-বিড়ির কুনু দোকান নাই। সাব-কন্ট্রাক্টর দুলাল মটরসাইকেল দিয়া লোক পাঠায়া বেনসন আর মাম পানি নিয়া আসে। মাঝে মাঝে সিঙারা অথবা বোম্বে চানাচুর।
কান্ট্রিবোটে জিওব্যাগ ভইরা বস্তা আসে। প্রতি বোটে ১০০ নস। আমি কোয়ালিটি দেখী। বালির এফ এম চেক করি, বস্তার ভরা চেক করি। অধিকাংশই টিকে না। এরা বালি ভরে চর থেকে....এফ এম মিলে না...দৈবাত ক্রমে মেলে। বস্তা ঠিক মত ভরা হয় না। পানিশমেন্ট দেই, নৌকা বসায় রাখি...লেবাররা " আমাকে ঘিরে ছার ছার, এইবার ছাইরা/মাধ কইরা দ্যান ছার-আর হবে না ছার" করে। সাব-কন্ট্রাক্টর আর এস ও রা আমারে শুনায়া ধুমায়া গালাগালি করে লেবারদের, তারপর আমার দিকে চায়....আমি মাথা নাড়ি। এরা লাফাতে লাফাতে চলে যায়।
লেবারদের অমানুষিক পরিশ্রম, প্রায় ২ কিলো দূর থেকে জিও ব্যাগ ভরে নৌকায়, তার পর নৌকা বেয়ে চলে আসা....আসতে আসতে নৌকার উপরে ভাত খাওয়া...তারপর পারমিশন নিয়ে স্ট্রিপে দড়ি, লগি, ম্যানুয়েলি যে ভাবে পারে বস্তাগুলো পানিতে ফেলে। সাবধানে ফেলতে হয় না হলে দুপাশের ওয়েটের ব্যালেন্সে সমান না হলে, নৌকা উল্টানোর ভয় আছে। মাঝে মাঝে উপুর হয়ে থাকা বস্তা আর কম পানির জায়গায় নৌকা যায় না, তখন বস্তা দড়িতে বেধে টেনে এনে ফেলতে হয়। এরা কত পায় এর জন্য-২১ টাকা প্রতি বস্তা। এর মধ্যে আছে নৌকার মাঝি আর লেবার সর্দারের পারসেন্টেজ। সব দিয়ে ১২-১৬ টাকা থাকে। দেশের যে কোন অবকাঠামো উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ের এই অফিসার, কন্ট্রাকটর আর লেবারাই প্রকল্প সময়ের ৭৫% কাজ সম্পন্ন করে।তবে প্রজেক্ট সাকসেসর ক্রেডিটটা থিংক ট্যাংক/ টপ লেভেল অফিসারাই বেশি নিয়ে নেয়। অবশ্য ফোরামের বাইরে কেউ কেউ ব্যাক্তিগত ভাবে মূল্যায়িত করে....এটাই শান্তি।
দু:খ এটাই যে এক মাসের মধ্যে গায়ের রংটা কালো হয়ে গেছে। ফেয়ার এন্ড হ্যান্সসামের থিওরী অনুযায়ী আমার ভবিষৎ অন্ধকার।
(২)
নদীর প্রেমে পরে গেছি। বিষেশ করে পদ্মার। কবিরা ভরা যৌবন বলতে যা বুঝায় আর কি! পানি বাড়ছে। বাড়ছে শান্ত নদীর উচ্ছৃঙ্খলতা। ঢেউগুলো হাইট বাড়ছে। সাদা সাদা ফেনা। এই বর্ষায় প্রমত্ত হয়ে উঠার অপেক্ষায়। চৈত্রের শেষ থেকেই বিকালে প্রায় উত্তর দিক থেকে কালো মেঘে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী। বালি চরে প্রবল বাতাস বালিঝড় পড়ে গেলাম একবার। অদ্ভুত একটা ব্যাপার রৌদ্রজল আবহাওয়া হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে গেল। নদীর পানি হয়ে গেল কালচে আর ঢেউগুলো হয়ে গেল উম্মত্ত। বাতাসের বেগ কত ছিলো বলতে পারবো না তবে আমাকে (৮৮ কিলো) কে পিছিয়ে এনেছিলো তিন পা। কোনরকমে তীরে এক লোকাল পিপলের বাড়িতে ঢুকলাম। আমার সাথে সেই ঘরে ছিলো আমার এস ও মিজান. ওয়ার্ক এসিসেটন্ট চন্চল, দুলাল আর ঘরের মালিকের পরিবারের সাথে দুইটা গরু, একটা বিড়াল আর ছাগল। বাইরে ব্যাপক ঝড়। ঘরের চাল মড়মড় করছে। কখন যে চাল উড়ে যায় আল্লাহ মাবুদ। আমি দড়জায় দাড়িয়ে ঝড় দেখছি। মুখে বালি কিচ কিচ করছে। কাজী নজরুল ইসলাম জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হেসেছিলেন আমি প্রলয়ংকারী ঝড়ের মাঝে দায়িরে বিড়ি ধরালাম (চার থেকে পাচঁটি কাঠি লেগেছে-আমার মনে হয় রেকর্ড)।
প্রায় এক ঘন্টা পড় ঝড় থামলো। বের হয়ে দেখলাম লেবার শেডের চাল উড়ে গেছে। ঢালাই চলছিলো-পানি দিয়ে সয়লাব। ডাম্পিং-এর নৌকার অবস্থা শোচনীয়। তাও ভালো যে ডুবে যায় নাই। কেউ কেউ ভয়ে ব্যাগ পানিতে ফেলে দিয়েছে। ১০০ টা আনছিলো এখন আছে ৩০ টা। যাক ঝড়ের পরে সবাইকে ছাড় দিয়ে দিলাম।
(৩)
ফরিদপুরে আমাদের সাইট আছিলো একটা ব্রোথেলের পাশে। আমার বড় ইচ্ছা আছিলো ব্রোথেলটা ক্যামন তা জানা। কিন্তু অফিসার মানুষ-ভদ্রলোক। তাই সাইটেই যারা ব্রোথেলে মাঝে মাঝে যায় এমুন কয়েকজনের সাথে খাতির জমায়া কিছু জানার চেষ্টা করছিলাম।
-রেইট কিমুন?
-(লাজুক হাসি) স্যার আপনে জানার দরকার কি?
-কত? পন্চাশ?
-ওই রকমই বিশ-পন্চাশ।
-এইটা উঠায় দিয়া-এগোরে পুনর্বাসন করা যায় না?
-প্রশাসন করে নাতো।
-পুলিশে ফিটিং খায়?
-তাতো খায়ই।
-এইটা থাকলে ওগোরই লাভ..?
-হ
বেশ্যারা মরলে ওদের জানাযা হয় না। কোন মৌলবী পড়ায় না। এরা একরকম এক ঘরে। চিকিৎসা নাই। গরু মোটাতাজা করনের ওষুধ খায়। বেশ্যাদের মেয়ে সন্তানরাও মায়ের পথেই চলে আসতে বাধ্য হয়।
আমি পদ্মার জলে পা ডুবিয়ে আছি। এর আপস্ট্রিমে ব্রোথেলের অধিবাসীরা গোছল সারে, কাপড় ধোয়। সেই শরীর ভেজা পানি আমার পায়ে লাগছে। এতে কি আমার জাত গেলো??? লালন বলেছেন
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
এক জলেই সব হয় গো শুচি....
এই জলের সৃষ্টিকর্তা কি সবাইকে সূচি করবেন না।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন